ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় শহরগুলির মধ্যে একটি হল পুনে। ভারতের অষ্টম বৃহত্তম মহানগর এবং মহারাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। মুম্বাই থেকে ১৬১ কিলোমিটার এবং লোনাভালা থেকে মাত্র ৬৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই শহরটি মহারাষ্ট্রের বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্রগুলির মধ্যে অন্যতম। মারাঠা আমলের দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ গুলো এই বৈচিত্রের শহরে সমৃদ্ধি যোগ করে।

শনিবার ওয়াদা ফোর্ট ( Shaniwar Wada) পুনের সবচেয়ে আইকনিক স্থাপত্যের মধ্যে অন্যতম। পেশোয়াদের শাসনকালে শনিবার ওয়াদা মারাঠা সাম্রাজ্যের ক্ষমতার আসন হিসেবে কাজ করেছিল। জনমত অনুসারে এই ফোর্ট টি পৃথিবীর অন্যতম ভৌতিক একটি স্থান। ১৩ মহলা এই বিশাল প্রাসাদটি ১৭৩০ সালে পেশোয়া বাজিরাও তৈরি করেছিলেন। এক বছরের মধ্যেই স্ত্রী কাশীবাই ও পুত্র নানাসাহেবের তাঁকে ধোঁকা দেন সিংহাসনের লোভে, এই আঘাত তিনি সহ্য করতে না পেরে কিছুদিনের মধ্যেই মারা যান। এরপর থেকে শনিবার ওয়াদা ফোর্টে সিংহাসনের লড়াই চলতেই থাকে, যা গোটা বংশের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৮২৮ সালে হঠাৎ করে এই ফোর্টে আগুন লেগে অধিকাংশই পুড়ে ছাড়খার হয়ে যায়। এই আগুন কিভাবে লেগেছিল আজ পর্যন্ত তা জানতে পারেনি। শনিবার ওয়াদা কে একটি অভিশপ্ত স্থান বলে মনে করা হয়, আজও নাকি এই প্রাসাদের মধ্যে বাজিরাও এর নাতি নারায়ণ রাও এর কান্না শুনতে পাওয়া যায়।
যদিও পেশোয়ারা সাম্রাজ্যের প্রধান মন্ত্রী পরিসদ ছিলেন, কিন্তু সেসময় রাজা ছিলেন ভোঁসলে রাজবংশের লোক। তারা কয়েক বছর ধরে সাম্রাজ্যের শাসনভার সামলে ছিলেন কারণ নতুন প্রজন্মের সাথে শিবাজির বংশধরের প্রভাব হ্রাস পেয়েছিল।

যাইহোক, যখন পেশোয়া বাজিরাও এর পুত্র নানাসাহেব পুনের সিংহাসনে বসেন, তখন পেশোয়ারা যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। নানা সাহেবের তিন পুত্র ছিল – বিশ্বরাও, মাধবরাও এবং নারায়ণ রাও। মারাঠা এবং আহমেদ শাহ দুরানির সঙ্গে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ শেষ হওয়ার মুখে। এই যুদ্ধেই পেশোয়া নানাসাহেব তাঁর প্রথম সন্তান বিশ্বরাও ( Vishwarao) কে হারান।
যুদ্ধে বড় সন্তান কে হারানোর শোক পেশওয়ার পক্ষে খুব বেশিদিন সহ্য করা সম্ভব ছিল না, এর কিছুদিন পরেই তিনি মারা যান। তাঁর দ্বিতীয় পুত্র মাধবরাও সিংহাসনে বসেন। একজন দক্ষ যোদ্ধা এবং উপযুক্ত শাসক হওয়া সত্ত্বেও মাধবরাও এর শাসনকাল খুব অল্প সময়ের ছিল। এর প্রধান কারণ যক্ষা রোগে তাঁর অকালমৃত্যু এবং জীবদ্দশায় কাকা রঘুনাথ রাও এর সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন লড়াই তাঁকে বিব্রত করে তুলেছিল।

রঘুনাথ রাও ছিলেন নানাসাহেব এর ছোট ভাই। ভাইপোর বিরুদ্ধে অবিরাম ষড়যন্ত্র করার অপরাধে রঘুনাথরাও এর অবশ্যই মৃত্যুদন্ড প্রাপ্য ছিল, কিন্তু গৃহবন্দী হওয়ার চেয়ে গুরুতর শাস্তি তাঁর কখনোই হয়নি। মাধবরাও যখন মারা গেলেন তখন শনিবার ওয়াদা প্রাসাদের অভ্যন্তরে রঘুনাথরাও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। নানাসাহেবের তৃতীয় পুত্র তরুণ নারায়ণরাও সিংহাসনে বসেন এবং একইভাবে উচ্চাকাঙ্খী ক্ষমতালোভী কাকা রঘুনাথরাও এর নিরলস বিরোধিতার ও ষড়যন্ত্রের শিকার হন।
রঘুনাথ রাও সম্পর্কে জরুরি বিষয়টি হল তার চতুরতা, এত অপরাধ করা সত্ত্বেও তিনি ভাইপোর চোখে ঠিক নিজেকে ভালো প্রমাণিত করতে সক্ষম হন। মাধবরাও এর অকালমৃত্যুর পর তিনি গৃহবন্দী দশা থেকে মুক্তি পান এবং নারায়ণ রাও এর কাছে রিজেন্টের দায়িত্ব পান, নারায়ণ রাও মাত্র ১৭ বছর বয়সে পেশোয়া হন। এত অপকর্মের পরেও রঘুনাথ রাও তাঁর মনিবের রিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখেন এবং সেটিকে পরিণতি দেন ১৭৭৩ সালের ৩০ অগাস্ট মধ্যরাতে।

জনশ্রুতি অনুসারে রঘুনাথ রাওর বিশ্বস্ত সেনারা মধ্যরাতে পেশোয়া নারায়ণ রাও কে আক্রমণ করেছিল। প্রতিরক্ষাহীন যুবক পেশোয়া তাঁর প্রাসাদের করিডোর দিয়ে ছুটে এসে কাকার কাছে সুরক্ষার জন্য প্রাণভিক্ষে করেন। কিন্তু ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে যাওয়া রঘুনাথ রাওয়ের কানে ভাইপোর চিৎকার, কান্নাকাটি কোনও টাই প্রবেশ করেনা। তাঁরই চোখের সামনে সেনারা নারায়ণ রাও কে কুপিয়ে হত্যা করেন। কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন যে রঘুনাথ রাও কেবল তাঁর ভাইপো কে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর স্ত্রী আনন্দী বাই একটি চিঠি বদলে দিয়ে এটি হত্যার আদেশে পরিণত করেন।
কিন্তু রঘুনাথ রাওয়ের রাজা হওয়ার স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যায় মূলত রাজ্যের অনুগত প্রজা ও মন্ত্রী পারিসদের কারণে। পরবর্তী দুই প্রজন্মের মধ্যেই এই সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে, রঘুনাথ রাওয়ের পুত্র দ্বিতীয় বাজিরাও এর আমলে এটি ইংরেজদের দখলে চলে আসে।
আজ প্রায় আড়াই শতক পরেও শনিবার ওয়াদায় পূর্ণিমার গভীর রাতে এক তরুণ ছেলের চিৎকার শুনতে পাওয়া যায়, যে ভীত সন্ত্রস্ত ভাবে প্রাসাদের করিডোর দিয়ে ছুটে এসে কাকার কাছে নিজের প্রাণভিক্ষা করছে। ওখানকার মানুষজন এই জায়গা কে অভিশপ্ত বলে মনে করে, নারায়ণ রাও এর অতৃপ্ত আত্মা হয়তো আজও প্রাসাদের মধ্যে নিজের প্রাণ বাঁচানোর আর্তনাদ করতে করতে ছুটে চলেছে।
GIPHY App Key not set. Please check settings