বহুল প্রতীক্ষিত ওয়েব সিরিজ The Family Man এর দ্বিতীয় সিজন এখন Amazon Prime Video তে স্ট্রিমিং।
প্রথম সিজনে আমরা দেখতে পাই একজন খুবই সাধারণ অথচ ধুরন্ধর গোয়েন্দা শ্রীকান্ত তিওয়ারি ওরফে মনোজ বাজপেয়ী কে, যিনি দিনরাত নিজের দেশের প্রতি নিজের দায়িত্ব ও অবসর সময়ে নিজের পরিবারের প্রতি কর্তব্য পালনের মধ্যে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করেছে। 2019 সালের সেরা হিন্দি ওয়েবসিরিজ The Family Man শেষ হয় একটি কেমিকাল ফ্যাক্টরি তে, ভিলেন মুসা মারা গেলেও দিল্লি কে গ্যাস আক্রমণ থেকে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো গেল কিনা আমরা জানতে পারিনা। তার উত্তর মেলে সিজন 2 তে ।

Amazon Prime Video তে প্রিমিয়ার হওয়া ফ্যামিলি ম্যানের দ্বিতীয় সিজনে রাজ ও ডিকে এর সঙ্গে একজন নতুন পরিচালকের এন্ট্রি হয় সুপ্রান এস ভার্মা৷ গল্পের শুরু হয় উত্তর শ্রীলঙ্কার একটি দ্বীপে যেখানে শ্রীলঙ্কার তামিল রিবেলরা সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছে, এরা নিজেদের স্বাধীনতা সংগ্রামী বলে মনে করে। আপনি যদি তামিল ভাষা না জেনে থাকেন তবে টানা সাত মিনিট ধরে আপনাকে সাবটাইটেল পড়ে বোঝার চেষ্টা করতে হবে এরা কি কথাবার্তা বলছে। যেখানে প্রথম সিজনে আইএসআই জঙ্গি ছিল, সেই জায়গায় এখানে পাকিস্তানের গোয়েন্দা ইউনিট তামিল রিবেল দের সাথে একজোট হয় ভারতের প্রধান মন্ত্রীকে (সীমা বিশ্বাস) হত্যা করার উদ্দেশ্যে।
এরপর গল্পের মোড় ঘোরে মুম্বাই তে। যেখানে শ্রীকান্ত তাঁর Threat Analysis and Surveillance Cell ( TASC) এর চাকরি ছেড়ে একটি আইটি ফার্মে যোগ দিয়েছে। পরিবারকে সময় দিতে এখন সে 9টা 5টার রুটিন মেনে বাচ্চাদের স্কুলে ছেড়ে চাকরিতে ঢোকে, আবার অফিস শেষ করে বাচ্চাদের নিয়ে বাড়ি ফেরে। খাবার টেবিলে একসাথে কোয়ালিটি টাইম কাটানো সত্তেও কোথাও যেন খামতি থেকে যায়। এই নতুন চাকরি শ্রীকান্তকে সুন্দর জীবন দিতে অপারগ, স্ত্রী সুচিত্রা ( প্রিয়মণি) তাঁর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, মেয়ে ধৃতি ( অ্যাশলেশা ঠাকুর) বড় হয়েছে, এখন সে নিজের মত করে সময় কাটাতে পছন্দ করে। অন্যদিকে শ্রীকান্ত ও নিজের চাকরিতে খুশি নয়, তাঁর 28 বছরের বস সর্বক্ষণ পিছনে পড়ে থাকে আর শ্রীকান্ত কে ‘মিনিমাম গাই’ (Don’t be a minimum guy) না হওয়ার পরামর্শ দেয়। একই রকম থেকে যায় শ্রীকান্তের পুরনো সহকর্মী এবং সবচেয়ে কাছের বন্ধু JK (শারিব হাসমি) যিনি নতুন চাকরিতে শ্রীকান্তের দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার কষ্ট টা অনুভব করে পারে।

প্রথম সিজনের নিরপরাধ করিমের মৃত্যুর জন্য আজও শ্রীকান্ত নিজেকে অপরাধী মনে করে, সেই অপরাধবোধ তাঁকে আবারও স্বীকারোক্তি করায় করিমের প্রেমিকার কাছে। টেরোরিস্ট অ্যাটাক কে কেমিক্যাল গ্যাস লিকের ব্যাখ্যা দিয়ে শ্রীকান্তের বস, সহকর্মী মিলিন্দ এবং জোয়ার প্রতি যে অন্যায় আচরণ করেছিল তা শ্রীকান্ত কে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করে। অন্যদিকে গত সিজনে লোনাভালা তে সুচি এবং অরবিন্দের মধ্যে কি ঘটেছিল সেটা স্পষ্ট না করলেও সুচির অপরাধবোধ দেখে সহজেই অনুমান করা যায়। মনোবিজ্ঞানীর চরিত্রে শেষবারের জন্য স্বর্গীয় আসিফ বাসরাকে দেখা একটি উপরি পাওনা। অসুখী দাম্পত্য, প্রাইভেট যবের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে আমাদের প্রিয় শ্রীকান্ত আবার ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন অর্থাৎ টাস্ক ফোর্স জয়েন করে।
মনোজ বাজপেয়ীর চিরাচরিত দুর্ধর্ষ পারফরম্যান্স নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। নিজের সম্পূর্ণ সত্তা দিয়ে অভিনয় করার ক্ষমতা খুব কম লোকেরই থাকে। সিরিয়াস মুড থেকে সেকেন্ডের মধ্যে হিউমারে সুইচ করা শ্রীকান্তকে নতুন করে ভালোবাসতে বাধ্য করবে । তেমনই মুগ্ধ করে জেকে তথা শারিব হাশমির অভিনয়। বাজপেয়ী ও হাশমির অসাধারণ যুগলবন্দী ফ্যামিলি ম্যানের আসল প্রাণবিন্দু। স্ক্রিনে হাশমির উপস্থিতি দর্শককে স্বস্তি দেয়, কঠিন পরিস্থিতিতে বাঁচার রসদ জোগায়। রাজির হাতে গুলি খাবার পর জেকে বেঁচে আছে কিনা বা পরের সিজনে তাঁকে দেখতে পাবো কিনা এই উৎকন্ঠা আপনাকে ভোগাবেই।

The Family Man 2 সিরিজের আসল সারপ্রাইজ প্যাকেজ হল রাজি ওরফে সামান্থা আক্কেনেনি। রিলিজের আগেই সামান্থার চরিত্রটি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। দ্বিতীয় সিজনে বাজপেয়ী কে টক্কর যদি কেউ দিতে পেরেছে সে হল সামান্থা। তাঁর রুদ্ধশ্বাস পারফরম্যান্স প্রথমে চমকে দেবে,তারপর ভাবাবে। রাজিকে আমরা প্রথম দেখতে পাই একটি ফ্যাক্টরি তে মাথা নিচু করে চুপচাপ কাজ করতে। মুখচোরা, সরল সাধাসিধে গ্রামের মেয়ে যাকে কখনও ভীড় বাসে নোংরা স্পর্শ সহ্য করতে হয়, আবার কখনও ফ্যাক্টরির ফোরম্যান এর যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। রাজিকে এখানে খাঁচায় বন্দী বন্য পশুর সাথে তুলনা করা যায়। মুহুর্তের মধ্যেই ভীত অত্যাচারিত রাজি হিংস্র পশুর মত ঝাঁপিয়ে পড়ে খুন করে, আবার পরমুহূর্তেই একদম ঠান্ডা শীতল স্নায়ু। এলমের প্রতি নিজের দেশপ্রেম প্রমাণ করার সুযোগ কোনো দিনই আর পাবেনা মনে করে যখন সে আত্মহত্যার পথে পা বাড়াতে যায় ঠিক সেইমুহুর্তে একটা ফোন তাঁকে ফিরিয়ে আনে। রাজি জানতে পারে তাঁকে একটি বিশেষ মিশনের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে। গোরিলা পদ্ধতিতে ট্রেনিং প্রাপ্ত রাজি আসলে আসলে একজন তামিল রিবেল সেনাবাহিনীর সদস্যা এবং দক্ষ পাইলট।

দিল্লি তে নার্ভ গ্যাস অ্যাটাক ব্যর্থ হওয়ায় আই এস আই অপারেটিভ মেজর সমীর ( দর্শন কুমার) ভারতের ওপর আরেকটি সন্ত্রাস হামলার পরিকল্পনা করেন। তবে এই প্ল্যানটি স্থানান্তরিত হয় শ্রীলঙ্কা, তামিলনাড়ু এবং লন্ডনে। তামিল বিদ্রোহীদের একটি স্লিপার সেল পাকিস্তানি আই এসআইয়ের সাথে ভারত ও শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর ওপর আক্রমণ করার জন্য সক্রিয় হয়। লন্ডন ও ফ্রান্সের নির্বাসিত তামিল বিদ্রোহী নেতারা ভারত ও শ্রীলঙ্কার পুরনো বিদ্রোহী অনুগতদের নিয়ে তৈরি করে মিশন জুলফিকার 2.0। আর এর পরিকল্পনা কে বাস্তবায়িত করে আত্মবলিদানে সম্মত হয় রাজি ওরফে সামান্থা। এর সাথে সহযোগিতা করে প্রথম সিজনের স্কুটার বোমার হামলাকারী সাজিদ (শাহাব আলি)। তামিলদের বিদ্রোহকে কলঙ্কিত করার যে অভিযোগ উঠেছিল ট্রেলার লঞ্চের পর, তা সর্বোতভাবে মিথ্যে প্রমাণিত হয়। নির্মাতারা এই সিরিজে তামিল বিদ্রোহী ও তাদের আন্দোলনের প্রতি প্রচন্ড সহানুভূতি দেখিয়েছেন। শ্রীলঙ্কার সরকার ও সেনাবাহিনীর হাতে সংখ্যালঘু তামিল সম্প্রদায় যে নৃশংসতার মুখোমুখি হয়েছে একাধিকবার তার উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে জুলফিকার 2.0 মিশনকে বাস্তবায়িত করার পথে পরিচালক প্রথম এপিসোড থেকেই প্রচুর সাবপ্লট ব্যবহার করেছেন যেগুলো কিছু জায়গায় অনাবশ্যক মনে হয়েছে। প্রথম সিজনের তুলনায় দ্বিতীয় সিজনটির শ্লথ গতিতে চলতে শুরু করে,তবে শেষ তিনটি এপিসোডে দুর্দান্ত ভাবে কাহিনী তার নিজস্ব ছন্দে ফেরে এবং পুরনো ধারা অনুযায়ী শেষ এক ঘন্টার মধ্যে দ্রুততার সাথে পরিণতিতে পৌছায়।

একটু আক্ষেপের জায়গা আসে সামান্থার জন্য, অনেকটা সময় পার করে তাঁকে গল্পে আনা হয়েছে। রাজির ডায়লগের সংখ্যা হাতে গুনে বলা যায়। রাজি চরিত্রে সামান্থা বুদ্ধিমত্ততার সঙ্গে নিজের শরীরী ভাষা ব্যবহার করেছেন, এক এক সময় তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলেটের তীব্রতাকেও হার মানিয়ে দেয়। কম্ফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ অন্যরকম একটি চরিত্র দিয়ে বলিউড ডেবিউ করা সামান্থাকে কুর্নিশ জানাতেই হয়।
আরও পড়ুন : সংকটের মুখে The Family Man 2 : নিষেধাজ্ঞা জারি তামিলনাড়ু সরকারের
এবারে আসি সমস্যার জায়গায়, Family Man এর প্রথম সিরিজের সাথে তুলনা করলে এই দ্বিতীয় সিজনটি তুলনামূলক ঠান্ডা। আরেকটি বড় সমস্যা হল ভাষা, এই জায়গায় পরিচালক একটু বেশিই সেফ খেলতে চেয়েছেন। গল্পের ৫০ ভাগ কথোপকথন হয়েছে তামিল ভাষায়, ৩০ ভাগ ইংরেজি আর ২০ ভাগ হিন্দিতে। ফ্যামিলি ম্যান সিরিজটি মূলত হিন্দি দর্শকের দ্বারাই জনপ্রিয় হয়েছিল, কিন্তু দ্বিতীয় সিজনটি দেখে মনে হল যেন সাউথ ইন্ডিয়ান দর্শককে মাথায় রেখেই বানানো হয়েছে। বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে গিয়ে নন তামিল দর্শককে অধিকাংশ সময় সাবটাইটেল পড়েই কাটতে হচ্ছে। তাছাড়া ফ্যামিলি ম্যানের এই নতুন সিজনে শ্রীকান্তের ফ্যামিলির কোনও প্রগ্রেস দেখানো হয়নি, আগের সিজনে সম্পর্ক ঠিক যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল এখনও তাই আছে। পরবর্তী সিজনেও তার অন্যথা হবে বলে মনে হয়না, শ্রীকান্তের সাথে জরুরি কথা বলতে সুচির বোধহয় আরও কয়েকটি সিজন প্রয়োজন।

শেষ এপিসোডে চমকপ্রদ পারফরম্যান্স দেখা যায় শ্রীকান্তের মেয়ে ধৃতির। অ্যাশলেশার এইরকম অভিনয় একাধারে চমকে দেয় আবার মুগ্ধও করে। বিশেষ উল্লেখ করতে হয় সিরিজের সিনেমাটোগ্রাফার ক্যামেরন ব্রায়োসন এর, তাঁর দুর্দান্ত ক্যামেরার কাজ আক্ষরিক অর্থেই আমাদের উড়ন্ত বুলেটের পথে নিয়ে যায় এবং এডিটর সুমিত কোটিয়ান যিনি দক্ষতার সঙ্গে এতগুলো সমান্তরাল ঘটনাকে এক সুতোয় গেঁথেছেন। কলাকুশলীদের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স, গল্পের চমক, সুন্দর এডিটিং সব মিলিয়ে মন্দ লাগবেনা, দেখে ফেলুন Amazon Prime Video তে The Family Man season 2.
The Family Man Season 2
Creators: Krishna D.K, Raj Nidimoru
Cast: Manoj Bajpayee, Samantha Akkineni, Sharib Hashmi, Priyamani
Rating: 3.5 out of 5
GIPHY App Key not set. Please check settings